পরিবহন মালিক শ্রমিকের হুমকিতে ‘অকার্যকর’ নতুন সড়ক আইন

Passenger Voice    |    ০৬:১২ পিএম, ২০২০-০৭-২৯


পরিবহন মালিক শ্রমিকের হুমকিতে ‘অকার্যকর’ নতুন সড়ক আইন

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও তা দীর্ঘদিনেও পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। গত বছরের নভেম্বরে নতুন আইনটির প্রয়োগ শুরু হলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এতে সরকার আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দেয়। গত ৯ মাসে ঢাকা মহানগরীতে ট্রাফিক পুলিশ সীমিত আকারে আইনের প্রয়োগ করলেও সারা দেশে অনেকটা স্থবির অবস্থা রয়েছে। এখনো হয়নি নতুন আইনের বিধিমালা। হয়নি সংশোধনও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৯ মাস গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করে মামলা করা বন্ধ রেখেছে পুলিশ। ঢাকায় শুধু উল্টো পথে চলাসহ শৃঙ্খলা ভঙ্গের মামলা করা হচ্ছে। আন্দোলনের মুখে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আইনটি প্রয়োগ না করে কাগজপত্র নবায়নের সময় দেওয়া হয়েছিল। সেটি বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে। ঢাকার কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থাকলেও কিছু অপরাধে সর্বনিম্ন শাস্তির উল্লেখ নেই। বিধিমালা না হওয়ায় সেসব স্থানে অস্পষ্টতা থেকেই গেছে। প্রয়োজনীয় পস মেশিন, কাগজ স্লিপসহ সরঞ্জাম ও নির্দেশনা প্রদানেও কিছু ঘাটতি আছে। তাই করোনার সময় আগের দেওয়া ‘শিথিল থাকার নীতি’ মেনেই চলছেন দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যরা।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আইনের প্রয়োগ একেবারে হচ্ছে না তা সঠিক নয়, আমরা অনেক মামলা করছি। বিভিন্ন কারণে আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা আছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ কাগজপত্র নবায়নের সময়টিও ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আছে। তবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ট্রাফিক আইন অমান্য করলে নতুন আইনেই মামলা হচ্ছে।’ প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রাজ্জাক আরো বলেন, ‘বিধিমালা আমরা পাইনি। তবে এরই মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইস, জনবলসহ অনেক কিছুই হয়েছে। ঢাকা মহানগরীতে ক্রাইম ডিভিশনের মতোই ট্রাফিক পুলিশের আটটি ডিভিশন হয়েছে। করোনার কারণে রাস্তায় গাড়ি কম এবং এখন ঈদ-পূববর্তী শৃঙ্খলার কাজের কারণে মামলা কম হচ্ছে।’

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাসচাপায় নিহত হওয়ার   ঘটনায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মুখে ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস হয়। এতে সড়কে আইন ভঙ্গে জরিমানা বেড়েছে ১০ থেকে হাজার গুণ। বেড়েছে কারাদণ্ডও। আগের আইনে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর জরিমানা ছিল ৫০০ টাকা। নতুন আইনে সর্বোচ্চ জরিমানা ২৫ হাজার টাকা। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও এভাবে জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। গাড়ির আকার পরিবর্তন, সড়কে কাউকে আহত, নিহত করার মামলা জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। 

এক বছরের বেশি সময় পর গত বছরের ১ নভেম্বর আইনটি কার্যকর করার ঘোষণা দেয় সরকার। ৪ নভেম্বর ‘সচেতনতার’ কথা বলে আইনের প্রয়োগ দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়। আইন কার্যকর ঘোষণার পরই গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে পরিবহন শ্রমিকরা জেলায় জেলায় ধর্মঘট শুরু করেন। সপ্তাহখানেক পরিবহন খাতে অচলাবস্থা চলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আইনের ১২৬টি ধারার তিনটির প্রয়োগ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। যানবাহনের ফিটনেস নবায়ন ও লাইসেন্স হালনাগাদ করার জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। এই সময় পর্যন্ত লাইসেন্স ও ফিটনেসের বিষয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। আইনের কিছু ধারা সংশোধনের আশ্বাসে ২৩ নভেম্বর ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন শ্রমিকরা।

ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ এখন সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম এবং সড়কে শৃঙ্খলার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। করোনার কারণে লাইসেন্সসহ কাগজপত্র হালনাগাদের সময় ৩০ জুন থেকে বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে ফের গাড়ি বন্ধ করে অচলাবস্থা তৈরি করতে পারেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এ শঙ্কাতেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন কেউ কেউ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সার্জেন্ট বলেন, কিছু কিছু স্থানে এখনো হাতে মামলা দেওয়ার স্লিপ বা বই নেই। পস মেশিনও নেই। আইনে সর্বোচ্চ সাজার কথা থাকলেও সর্বনিম্ন উল্লেখ নেই। বিধিমালা না হওয়ায় অস্পষ্ট। আবার নির্দেশনা আছে উল্টোপথে আসা, মোটরসাইকেলের চালক বা যাত্রীর হেলমেট না থাকা, সিগন্যাল অমান্য করা ছাড়া কাগজপত্র যাচাই করে মামলা না করার। এসব কারণে শিথিলতা চলছে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য যাচাই করে আইন ভঙ্গের কারণে সামান্য কিছু মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। মহানগর পুলিশের মুখপত্র, ডিএমপি নিউজ পোর্টালে সর্বশেষ ৩১ অক্টোবরে ট্রাফিক আইন অমান্যের মামলা ও জরিমানার তথ্য রয়েছে। এরপর গত ৫ মার্চ মহাখালীতে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে শৃঙ্খলা ভঙের ১৫টি মামলায় ১২ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা আদায়ের তথ্য রয়েছে। নতুন সড়ক আইন পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় মামলার পরিমাণ ও জরিমানা আদায় কম হওয়ায় এসব তথ্য আর ডিএমপি নিউজে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র। তবে গত ৯ মাসে নতুন আইনটির ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে পুলিশের অনেক কার্যক্রমের তথ্য আছে নিউজে।